মানুষ নয়, নারীও নয়, হয় আমাদের ডাকছে মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা হিসাবে নাহয় ডাকছে বেশ্যা, মাগি, নেড়িবাদী, শাহবাগী, শাহমাগী বলে। এই বাইনারি পরিচয়ের বাইরে যেন আমাদের কোনো অস্তিত্ব নাই। কত কত পরিচয় জানছি রোজ। পত্রিকা হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া, রাস্তায় চলতে গিয়ে হোক বা ঘরে - শব্দগুলো যেমন গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে সবার, তেমনি আমাদের পরিচয় হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে।লজ্জা, ক্ষোভ, ঘৃণা, কান্না আসলেও দিন শেষ বেঁচে আছি এটাই যেনো এখন বিশাল পাওয়া, এই নামগুলো নয়!
কিন্তু কেনো ?
এই দেশের কোন খাতে আমরা অবদান রাখি নাই ? কৃষি, স্বাস্থ্য, পোশাক, ব্যবসা, শিক্ষা, অর্থনীতি-রাজনীতি - কোন জায়গায় আমরা দেশের ভার শুধু পুরুষদের ঘাড়ে চাপিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম যে তারা সেই ভারের কষ্টে আমাদের উপর ক্ষিপ্ত? সারাদিন ওয়াজ-মাহফিল কিংবা অফিসে মেয়েদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ঘরে ফেরার পর তাদের পাতে ভাত উঠানোর জন্য সেই মেয়েদের উপরেই এখনো বাংলাদেশের শতভাগ পুরুষ নির্ভরশীল।পেট ভোরে খেয়ে, ফেসবুকে আরো গোটা দশেক নোংরা কমেন্ট করার পর দাঁত খিলি করতে করতে আবার সেই নারীর সাথেই বিছানায় যায়! নিজের বংশ বাড়াতে, গোটা গুষ্টিকে দেখে-শুনে রাখতেও সেই আমাদেরকেই লাগে। তারপরেও পান থেকে চুন খসলেই গায়ে হাত। অনেকসময় তাতেও শান্তি হয় না। মেরে ফেলা, অঙ্গহানি করা, তালাক দেয়া, একাধিক বিয়ে করা, সন্তান ছিনিয়ে নেয়া, সম্পত্তির ভাগ না দেয়া - এতো রোজকার খবর। জানতে চাই কী এমন বিশাল অর্জন এই শিশ্নধারী মানবের যে সারাক্ষন তা প্রমান করার জন্য হাত- মুখ সব চলে ? নাকি তারা সবাই জেনে গেছে যে তাদের আসলেই কোনো ক্ষমতা নাই তাই গায়ের জোরে সবাইকে চুপ রাখতে চায় !
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথা মনে আছে? শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন নারীকে তারই সমমর্যাদার একজন পুরুষ কীভাবে অত্যাচার করে অন্ধ করে দিয়েছিলো? অল্প-শিক্ষিত আরেক মেয়ের বিয়ের পর পড়াশুনা বন্ধ করতে তার স্বামী তার ডান হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলো। বৃদ্ধ নারী, পর্দানশীন নারী, মেয়ে শিশু, মাদ্রাসার ছাত্র, গৃহকর্মী, পোশাকশ্রমিক- উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত- কাকে ছাড় দিচ্ছে আমাদের পুরুষেরা ? এদের কাছে তো জেন্ডার কোনো বিষয় না! সুযোগ পেলে এরা শুধু মানুষ না, পশুকেও বাদ দেয় না ! এখনতো আবার “পুরুষেরা” বলাতে, কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পরে বলবে - not all men! আচ্ছা মানলাম সবাই না, কিন্তু ধর্ষণ এবং শারীরিক ও যৌন সহিংসতার মতো কাজ কারা করছে সেটা বলেন আগে ? পুরুষ। যেই পুরুষ করছে না সে তখন কী করছে ? অন্যদিকে তাকিয়ে থাকছে, নাহয় না দেখার ভান করছে, অথবা দোষী পুরুষের সাফাই দিচ্ছে, নাহয় আমার পরিবারের সাথে হয় নাই তাই আমার মাথাব্যথা নাই ভেবে বসে আছে আর নাহয় এখনো করার সাহস হয় নাই বলে করছে না।
ফুলের মালা দিয়ে অর্ণবের বরণচিত্র কেমন লাগলো ? যারা সেই আয়োজনে ছিলেন সেখানে পুরুষ ছাড়া অন্য কেউ কী ছিলো? সোশ্যাল মিডিয়াতে ওই সংক্রান্ত পোস্টের নিচে কমেন্ট পড়েছেন ? তাদের মধ্যে কতজন পুরুষ মন্তব্যকারী ছিলো গুনেছেন ? সারাবছর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেশাপ করা আর গরমের তাপদাহে খালি গায়ে চলাফেরা করা নির্লজ্জ আপনাদেরকে কখনো কী কোনো নারী দ্বারা হেনস্থা হতে হয়েছে ? রাত ৮/৯টা বাজলেই রাস্তায় বের হতে ভয় লেগেছে কখনো ? লুঙ্গি উঁচু করে অর্ধেক শরীর দেখিয়ে রাস্তায় চলার সময় কোন মেয়ে বলেছে লুঙ্গি নামিয়ে ঠিকমতো চলুন ? বাড়িতে পুরুষ অতিথি আসলে নিজের পরিবারের সাথে লেপ্টে বসে থাকতে হয়েছে ভয়ে ? যদি কখনো লাগতো এরকম তাহলে বুঝতেন আমরা কিসের মধ্যে দিয়ে যাই রোজ !
Not All Men !
এই কথা সেদিন এসে বলবেন যেদিন একজন পুরুষ অপরাধী চিহ্নিত হলে দশজন পুরুষ তাকে ধরে বিচার চাইবে। মব জাস্টিসের নামে মব ভায়োলেন্স করছে দিনে দুপুরে। কাদের বিরুদ্ধে? মেয়েরা আপনাদের পছন্দসই কাপড় না পড়লে তাদের আক্রমণ করছেন, সিগারেট খেলে আক্রমণ করছেন, রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করছে না বলে আক্রমণ করছেন। আর সারাবছর ধরে যে ধর্ষণ হচ্ছে, এই এক রোজার মাসের এক সপ্তাহতেই কতগুলি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলো তখন কোথায় গেলো আপনাদের মব জাস্টিস ? তখন না যায় আপনাদের জাত, না যায় আপনাদের ধর্ম ! রোজার পবিত্রতা নিয়েও কোন প্রশ্ন আসে না!
জুলাই-পরবর্তী যে বৈষম্যহীন ও ন্যায়সঙ্গত বাংলাদেশ আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, তা আমাদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আসেন পরিসংখ্যান দেই। বালাদেশ মহিলা পরিষদের সংকলিত তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে ২,৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৫১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৩৬৭ জন কন্যাশিশু। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন। ধর্ষণের ফলে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৬ জন আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়াও, ৯৪ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন। যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৮১ জন, এবং বিভিন্ন কারণে ৫২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৭ জন কন্যাশিশু। পারিবারিক সহিংসতার কারণে ২৫ জন কন্যাশিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ফলে ১৪ জন নিহত হয়েছেন এবং ১ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া, ২৯ জন সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন।
এবার আসেন এই বছরে, নতুন বাংলাদেশের অবস্থা দেখি ! জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতেই মোট ৩৯৪ টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ৯৭ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩১ জন। শুধু জানুয়ারিতেই যৌন নিপীড়ন, যৌতুকসহ বিভিন্ন কারণে ১১ কন্যাসহ ৪৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্যাতিত ১৮৯ জনের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১০ জন, এর মধ্যে ৬ জন কন্যাশিশু। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন একজন নারী। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে তিনজন। যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে মোট ১৫ জন। গৃহকর্মী নির্যাতনের তিনটি ঘটনা ঘটেছে। দুইজন গৃহকর্মীকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।এগুলো শুধুমাত্র প্রকাশিত খবর ও রিপোর্টেড কেস থেকে প্রাপ্ত তথ্য, এর বাইরেও ঘরে-বাইরে নানারকম সহিংসতার শিকার নারীরা হচ্ছেন যা অনেকসময় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায় না।
বাবা ধর্ষণ করছে, আত্মীয় ধর্ষণ করছে, স্বামী ধর্ষণ করছে, রাস্তার অপরিচিত ব্যক্তিও করছে। এবার বলেন, মেয়েদের গৃহবন্দী করলেই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে কীভাবে তাহলে ? গৃহেও তো সে নিরাপদ নাই ! আপনাদের যৌন উত্তেজনার চাপ সামলাতে হচ্ছে আমাদের, আবার দিন শেষে গালিও দিচ্ছেন আমাদের ?
গত কয়েক সপ্তাহেই বাল্য বিয়ের কারণে এক ১৩ বছরের কিশোরী মা সন্তান জন্ম দেয়ার জটিলতায় মারা গেছে ঢাকার এক বস্তিতে।মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল ১২ বছরে।অপরদিকে গাইবান্ধায় ১৩ বছরের এক কিশোরী অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের দ্বারা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় যার বিচার বা চিকিৎসা কোনটাই তাকে নিতে দেয়নি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আয়োজিত সালিশে। আর মার্চ মাস কেবল শুরু, মাগুরার আট বছরের শিশু যাকে যৌন উত্তেজক কোনো অবতার নিয়ে ঘরের বাইরে কোথাও যেতে হয়নি, নিজের বোনের শশুরবাড়িতেই ভয়ঙ্করভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু বাড়ির নিচের দোকান থেকে চকোলেট কিনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাবা ধর্ষণ করছে, আত্মীয় ধর্ষণ করছে, স্বামী ধর্ষণ করছে, রাস্তার অপরিচিত ব্যক্তিও করছে। এবার বলেন, মেয়েদের গৃহবন্দী করলেই সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে কীভাবে তাহলে ? গৃহেও তো সে নিরাপদ নাই ! আপনাদের যৌন উত্তেজনার চাপ সামলাতে হচ্ছে আমাদের, আবার দিন শেষে গালিও দিচ্ছেন আমাদের ?
অপরদিকে আমাদের প্রথমবারের মতো পাওয়া উচ্চ শিক্ষিত, নিজ নিজ অঙ্গনে সফল এবং “নিরপেক্ষ” সরকার বিষয়টিকে জাতীয় সংকট হিসেবে স্বীকার না করে দাবি করছেন যে অপরাধের হার বৃদ্ধি পায়নি, বরং আগের মতোই রয়েছে। এখানে অবুঝ মন জানতে চায় যে এই আগের মতনটা কোন সময়কে নির্দিষ্ট করছে ? আন্দোলন করে যেই সরকারকে নামানো হয়েছে, যাদের ফেসিবাদী ও স্বৈরাচার বলা হচ্ছে তাদের সাথে কেন নিজেদের অবস্থান তুলনা করা হচ্ছে ? আগের সরকার দেশের অবনতির জন্য দায়ী বলেইতো আপনাদের এনে বসানো হয়েছে ঠিক করার জন্য, তাহলে দ্ৰব্যমূল্য থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলার দুরবস্থা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মতো সব কিছুতেই কেন আপনারা বারবার আগের সাথে তুলনা করছেন ? আপনাদের তো নতুন মানদণ্ড তৈরি করা উচিত যেখান থেকে সংস্কারকাজ শুরু হবে। আগের মতো অবস্থায় থাকার জন্য বা পূর্বের সাথে তুলনা করার জন্য বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আন্দোলন করা হয়নি। এখনতো আমাদেরও বলতে ইচ্ছা করে, ব্যাপরটা কেমন যেন আগের মতোই হয়ে গেলো, সব গদির দোষ ! ওখানে বসলেই সবাই ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি!
হায়!
সরকার আসে, সরকার যায়।
নারীর অবস্থান একই জায়গায়।
Samina Yasmin is a regular contributor to Swayong.org
Comments